কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে
চলতি বছর ডেঙ্গু অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। প্রতি বছর বর্ষাকালে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। কিন্তু এ বছর জুন থেকেই ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশাবাদ জ্ঞাপন করেছিলেন, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর নাগাদ ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে আসবে। কিন্তু নভেম্বরেও ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রকোপ অব্যাহত রয়েছে।
বণিক বার্তায় প্রকাশ, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে নতুন করে আরো আটজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬০৬ জনে। সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ তথ্য জানায়।
গত রোববার সকাল ৮টা থেকে সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ৯২০ জন ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ২১৯ ও ঢাকার বাইরের ৭০১ জন। ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া আটজনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা চারজন ও ঢাকার বাইরের চারজন। চলতি বছর সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে মোট ৩ লাখ ৯ হাজার ৮৭ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ১ লাখ ৭ হাজার ২৯৮ ও ঢাকার বাইরের ২ লাখ ১ হাজার ৭৮৯ জন। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৩ হাজার ৪৯৩ জন।
গত শতাব্দীর ষাটের দশকে এ দেশে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। এরপর ২০০০ সালে প্রথম বড় আকারে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ডেঙ্গু ছিল মূলত ঢাকা শহরকেন্দ্রিক। এরপর প্রতি বছর কমবেশি ডেঙ্গুর সংক্রমণ দেখা দিতে থাকে। তবে ডেঙ্গু বড় বড় শহরেই সীমাবদ্ধ ছিল। ২০১৯ সালে বড় শহরগুলোর পাশাপাশি কয়েকটি গ্রামেও ডেঙ্গু শনাক্ত হয়।
এ বছর ঢাকা শহরের বাইরে দুই লাখের বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে উপকূলের জেলাগুলোয় ডেঙ্গুর প্রকোপ নতুন ঝুঁকি বলে জনস্বাস্থ্যবিদরা মনে করছেন। চলতি বছর ৬৪ জেলায়ই ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে, বহু গ্রামের মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এর অর্থ ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে ৮৬৮ জন ডেঙ্গুতে মারা গেছে। কিন্তু এ বছর ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যু অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
ডেঙ্গু মোকাবেলায় যথাসময়ে ব্যবস্থা না নেয়াই উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য দায়ী বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) ভাষ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গু মোকাবেলায় হিউম্যান রিসোর্স বা জনবলের ঘাটতি এখন বড় চ্যালেঞ্জ। যে হারে রোগী বেড়েছে, সেই অনুপাতে দেশের হাসপাতালগুলোয় জনবল নিয়োগ হয়নি। এছাড়া এবার ডেঙ্গু গ্রাম পর্যায়ে ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে। ঢাকার চেয়ে ঢাকার বাইরে দ্বিগুণ রোগী শনাক্ত হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ঢাকার বাইরে এডিস নিয়ন্ত্রণে দৃশ্যমান কার্যক্রম কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নেই বলে প্রতিষ্ঠানটির অভিযোগ। এজন্য ডেঙ্গু মোকাবেলায় সমন্বিত উদ্যোগ নেয়ার পক্ষে মত দিয়েছে নিপসম।
এক্ষেত্রে টিকা এলে সমস্যার সমাধান হবে, এমন প্রতীক্ষার চেয়ে কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার প্রতিই জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করা হচ্ছে এমন অভিযোগও নতুন করে সামনে এসেছে। এজন্য প্রশাসন ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সমন্বিত ভূমিকা প্রয়োজন। সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়া হলে ডেঙ্গু আক্রমণের হার কমবে বলে আশা করা যায়। যেহেতু ডেঙ্গু এখন বছরব্যাপী সংক্রমণে পরিণত হয়েছে, সে হিসেবে এটি প্রতিরোধে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। এমনকি ডেঙ্গুকে জাতীয় সমস্যা চিহ্নিত করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের হস্তক্ষেপ জরুরি বলেও বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। মোদ্দাকথা, ডেঙ্গু যেন মহামারীতে রূপ না নেয় এবং ২০১৯ সালের মতো বড় আউটব্রেক না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
বস্তুত করোনা মোকাবেলায় যেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে সেভাবে মনোযোগ দেয়া হয়নি বলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এমনকি এ বছর মৃত্যু ১৬০০ অতিক্রম করলেও মশা নিধনে যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়ার অভিযোগও তোলা হচ্ছে। এভাবে একটি রোগের বিস্তার প্রতিরোধ না করলে তাতে সাধারণ মানুষের মৃত্যুর দায় এড়ানো যায় না। তাছাড়া চিকিৎসা ব্যয়ের যে ভোগান্তি তা অনেক পরিবারকে অসহায় করে তুলছে। তাই মৃত্যুর পরিসংখ্যান শুধু বছরের হিসাবে করলে হবে না, যাদের পরিবারের আপনজন ডেঙ্গুতে মারা গেছে তারাই স্বজনহারার বেদনা বুঝতে পারছে। আর সবচেয়ে বড় কথা ডেঙ্গুর চিকিৎসা পেতে যে অবর্ণনীয় ভোগান্তি পোহাতে হয়, তা ভুক্তভোগীরাই বুঝতে পারেন। তাছাড়া পরিসংখ্যানগুলোয় যারা শুধু হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসে, তাদেরই অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু যারা বাসায় চিকিৎসা নেয়, তারা পরিসংখ্যানের বাইরে থাকে। এজন্য ডেঙ্গুতে মৃত্যুর যে সংখ্যা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তুলে ধরেছে, প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আমরা প্রত্যাশা করব, ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ অচিরেই নিয়ন্ত্রণে আসবে। এজন্য যথোপযুক্ত সমন্বিত পদক্ষেপের যে তাগিদ দেয়া হচ্ছে, তা অবিলম্বে কার্যকর করা জরুরি। এজন্য শুধু প্রশাসনের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না, দেশের নাগরিকদেরও সচেতনতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসুক, এটিই আমাদের কাম্য।