ঢাকা ১০:০৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এশিয়ার বৃহত্তম বটবৃক্ষ বাংলাদেশে

মামুনর রশীদ রাজু, ব্যুরো চীফ, খুলনা

খুলনা বিভাগের ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ থানায় রয়েছে এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম বটগাছ। ১১ একর জায়গা জুড়ে রয়েছে এর বিস্তৃতি। এর উচ্চতা ২৫০ থেকে ৩০০ ফুট। বর্তমানে বটগাছটি খণ্ড খণ্ড হয়ে ৫২টি বটগাছে রূপ নিয়েছে।

গাছটার মূল কাণ্ড এখন নেই তবে স্তম্ভমূল থেকে সৃষ্ট ৪৫ টি উপকাণ্ড রয়েছে । এসব উপকাণ্ড থেকে নির্গত ৩৪৫ টি স্তম্ভমূল মাটিতে প্রবেশ করে নতুন কাণ্ড তৈরি করছে।

মল্লিকপুর গ্রামের প্রবীণদের একজন জানান, এ বটগাছটির বয়স কত তা আশপাশের গ্রামের লোকজনও বলতে পারে না। তিনি মুরব্বিদের কাছে শুনেছেন গাছটির বয়স ৩শ’ বছরের বেশি হবে। বটগাছের আশপাশে কুমার সম্প্রদায়ের বাস ছিল।

এটি সুইতলার বটগাছ বা সুইতলা মল্লিকপুরের বটগাছ বা বেথুলীর বটগাছ নামে পরিচিত। তবে সুইতলা নামে কোনো স্থানের অস্তিত্ব নেই সেখানে। বিবিসির এক জরিপে একে এশিয়ার সবচেয়ে বড় বটগাছ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে বলেই তথ্য পাওয়া যায়। ২০০৯ সাল থেকে সামাজিক বন বিভাগ যশোর এ বটগাছটির ব্যবস্থাপনা করে আসছে।

স্থানীয়রা জানান, ১৯৮২ সালের পূর্ব পর্যন্ত এশিয়া মহাদেশের মধ্যে বৃহত্তম বটগাছ বলে পরিচিতি ছিল কলকাতার বোটানিকেল গার্ডেনের একটি গাছ। পরবর্তীতে বিবিসির এক তথ্যানুষ্ঠানে প্রচার হয়-‘মল্লিকপুরের বটগাছই এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম।

এই স্থানটির মালিক ছিলেন কালীগঞ্জ উপজেলার রায় গ্রামের জোতদার নগেন সেনের স্ত্রী শৈলবালা সেন। পরে এটি খাস জমির আওতায় চলে আসে। আগে হিন্দুধর্মাবলম্বীরা নির্দিষ্ট তিথিতে গাছতলায় পাঁঠা বলি দিতেন। এ গাছের নিচে একটি কালীপূজার বেদি স্থাপিত হয়েছে। এখনো মানুষ তাদের ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী বিভিন্ন মানত, সিন্নি, পূজা অর্চনা করে থাকেন সেখানে।

স্থানীরা জানান, একটি কুয়ার পাড়ে ছিল এ গাছের মূল অংশ। সড়কের পাশে এ গাছটি ছিল ডালপালা পাতায় পরিপূর্ণ। গাছের তলায় রোদ-বৃষ্টি পড়ত না। মাঘ মাসের শীতের রাতেও গাছের নিচে গরম থাকত। গ্রীষ্মে গাছের নিচে লাগত ঠান্ডা। এই বটগাছের জন্ম যে কুয়ার পাড়ে সেই কুয়া কে-কবে খনন করেছিল তার সঠিক তথ্য নেই।

ঝিনাইদহ জেলা পরিষদ গাছটির গুরুত্ব বিবেচনা করে ১৯৯০ সালে বটগাছের পাশেই প্রায় ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি রেস্ট হাউজ নির্মাণ করে। রক্ষণাবেক্ষণ না করায় সেটিও এখন আর বাসযোগ্য নয়।

এশিয়ার সর্ববৃহৎ বটগাছ হিসবে পরিচিত এই গাছের গোড়ায় কোনো একসময় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ পূজা-অর্চনা শুরু করে।

এশিয়া মহাদেশের অন্যতম বৃহৎ এ বটগাছটির ঐতিহাসিক দিক বিবেচনা করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন অনেক দর্শনার্থী আসেন এখানে, আসেন বিদেশিরাও। বিস্তৃত বটগাছটির দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাখির কলরব, ছায়াঘেরা শীতল পরিবেশ মুগ্ধ করে দর্শনার্থীদের।

এশিয়ার বৃহত্তম বটগাছ ঘিরে প্রতিবারের মতো এবারো (বাংলা ১৪৩১) জমজমাট বৈশাখী মেলা।
……….

স্থানীয়দের মুখে গাছটি সম্পর্কে কথিত আছে, ক’বছর আগে কুদরতউল্লা নামে একজন গাছের ডাল কাটলে অসুস্থ হয়ে পড়ে। শুরু হয় রক্তবমি। কুদরতের স্ত্রী বটগাছ আগলে ধরে কান্নাকাটি করে। স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা চায়। অবশেষে তার স্বামী সুস্থ হয়ে ওঠে। এ রকম অনেক গল্প মল্লিকপুরবাসীদের কাছে শোনা যায়।

বটগাছটি কেন্দ্র করে পাশেই বাংলা ১৩৬০ সালের দিকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেথুলী বা মল্লিকপুরের বাজার। এই বাজারের প্রথম দোকানদার ছিলেন মল্লিকপুর গ্রামের বেলায়েত আলী, বেথুলী গ্রামের স্বরজিত কুমার সাহা, মমতাজ ডাক্তার, মল্লিকপুরের মুনছুর বিশ্বাস ও মথুরাপুর গ্রামের হামিদুল।

বটতলায় কালীপূজার জন্য একটি স্থায়ী পিঁড়ি তৈরি করা হয়েছে। চাপরাইল গ্রামের গৌর পদ অধিকারী এবং হাজারী লাল অধিকারীর আর্থিক সহায়তায় এটি নির্মিত হয়। এলাকাবাসী জানান, অযত্ন-অবহেলা, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব ও নানামুখী অত্যাচারের কারণে ঐতিহ্যবাহী এ বটগাছের অস্তিত্ব আজ নষ্ট হতে চলেছে।

মল্লিকপুর গ্রামের বেলায়েত মিয়া বেঁচে থাকা পর্যন্ত তিনি এসব দেখাশোনা করতেন। তিনি নিজ সন্তানের মতো ভালোবাসতেন এ বটবৃক্ষকে। যে কারণে এ বটগাছের কাছে সর্বপ্রথম দোকান দেন তিনি এবং বাজার প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৯৮ সালের দিকে কালীগঞ্জ উপজেলার ততকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা সুশেন চন্দ্র রায়ের সহযোগিতায় সেখানে একটি ফুলের বাগান তৈরি করা হয়। বটগাছের চারপাশ ঘিরে প্রাচীর নির্মাণের ব্যবস্থাও করেন তিনি।

তবে, বর্তমানে এশিয়ার বৃহত্তম এই বটবৃক্ষের যত্নে অনেক কিছুই করা বাকি রয়েছে বলেই মনে করেন অনেক দর্শনার্থী।

ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

আপডেট সময় ১২:১৫:২৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪
৩৫৪ বার পড়া হয়েছে

এশিয়ার বৃহত্তম বটবৃক্ষ বাংলাদেশে

আপডেট সময় ১২:১৫:২৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪

খুলনা বিভাগের ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ থানায় রয়েছে এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম বটগাছ। ১১ একর জায়গা জুড়ে রয়েছে এর বিস্তৃতি। এর উচ্চতা ২৫০ থেকে ৩০০ ফুট। বর্তমানে বটগাছটি খণ্ড খণ্ড হয়ে ৫২টি বটগাছে রূপ নিয়েছে।

গাছটার মূল কাণ্ড এখন নেই তবে স্তম্ভমূল থেকে সৃষ্ট ৪৫ টি উপকাণ্ড রয়েছে । এসব উপকাণ্ড থেকে নির্গত ৩৪৫ টি স্তম্ভমূল মাটিতে প্রবেশ করে নতুন কাণ্ড তৈরি করছে।

মল্লিকপুর গ্রামের প্রবীণদের একজন জানান, এ বটগাছটির বয়স কত তা আশপাশের গ্রামের লোকজনও বলতে পারে না। তিনি মুরব্বিদের কাছে শুনেছেন গাছটির বয়স ৩শ’ বছরের বেশি হবে। বটগাছের আশপাশে কুমার সম্প্রদায়ের বাস ছিল।

এটি সুইতলার বটগাছ বা সুইতলা মল্লিকপুরের বটগাছ বা বেথুলীর বটগাছ নামে পরিচিত। তবে সুইতলা নামে কোনো স্থানের অস্তিত্ব নেই সেখানে। বিবিসির এক জরিপে একে এশিয়ার সবচেয়ে বড় বটগাছ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে বলেই তথ্য পাওয়া যায়। ২০০৯ সাল থেকে সামাজিক বন বিভাগ যশোর এ বটগাছটির ব্যবস্থাপনা করে আসছে।

স্থানীয়রা জানান, ১৯৮২ সালের পূর্ব পর্যন্ত এশিয়া মহাদেশের মধ্যে বৃহত্তম বটগাছ বলে পরিচিতি ছিল কলকাতার বোটানিকেল গার্ডেনের একটি গাছ। পরবর্তীতে বিবিসির এক তথ্যানুষ্ঠানে প্রচার হয়-‘মল্লিকপুরের বটগাছই এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম।

এই স্থানটির মালিক ছিলেন কালীগঞ্জ উপজেলার রায় গ্রামের জোতদার নগেন সেনের স্ত্রী শৈলবালা সেন। পরে এটি খাস জমির আওতায় চলে আসে। আগে হিন্দুধর্মাবলম্বীরা নির্দিষ্ট তিথিতে গাছতলায় পাঁঠা বলি দিতেন। এ গাছের নিচে একটি কালীপূজার বেদি স্থাপিত হয়েছে। এখনো মানুষ তাদের ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী বিভিন্ন মানত, সিন্নি, পূজা অর্চনা করে থাকেন সেখানে।

স্থানীরা জানান, একটি কুয়ার পাড়ে ছিল এ গাছের মূল অংশ। সড়কের পাশে এ গাছটি ছিল ডালপালা পাতায় পরিপূর্ণ। গাছের তলায় রোদ-বৃষ্টি পড়ত না। মাঘ মাসের শীতের রাতেও গাছের নিচে গরম থাকত। গ্রীষ্মে গাছের নিচে লাগত ঠান্ডা। এই বটগাছের জন্ম যে কুয়ার পাড়ে সেই কুয়া কে-কবে খনন করেছিল তার সঠিক তথ্য নেই।

ঝিনাইদহ জেলা পরিষদ গাছটির গুরুত্ব বিবেচনা করে ১৯৯০ সালে বটগাছের পাশেই প্রায় ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি রেস্ট হাউজ নির্মাণ করে। রক্ষণাবেক্ষণ না করায় সেটিও এখন আর বাসযোগ্য নয়।

এশিয়ার সর্ববৃহৎ বটগাছ হিসবে পরিচিত এই গাছের গোড়ায় কোনো একসময় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ পূজা-অর্চনা শুরু করে।

এশিয়া মহাদেশের অন্যতম বৃহৎ এ বটগাছটির ঐতিহাসিক দিক বিবেচনা করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন অনেক দর্শনার্থী আসেন এখানে, আসেন বিদেশিরাও। বিস্তৃত বটগাছটির দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাখির কলরব, ছায়াঘেরা শীতল পরিবেশ মুগ্ধ করে দর্শনার্থীদের।

এশিয়ার বৃহত্তম বটগাছ ঘিরে প্রতিবারের মতো এবারো (বাংলা ১৪৩১) জমজমাট বৈশাখী মেলা।
……….

স্থানীয়দের মুখে গাছটি সম্পর্কে কথিত আছে, ক’বছর আগে কুদরতউল্লা নামে একজন গাছের ডাল কাটলে অসুস্থ হয়ে পড়ে। শুরু হয় রক্তবমি। কুদরতের স্ত্রী বটগাছ আগলে ধরে কান্নাকাটি করে। স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা চায়। অবশেষে তার স্বামী সুস্থ হয়ে ওঠে। এ রকম অনেক গল্প মল্লিকপুরবাসীদের কাছে শোনা যায়।

বটগাছটি কেন্দ্র করে পাশেই বাংলা ১৩৬০ সালের দিকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেথুলী বা মল্লিকপুরের বাজার। এই বাজারের প্রথম দোকানদার ছিলেন মল্লিকপুর গ্রামের বেলায়েত আলী, বেথুলী গ্রামের স্বরজিত কুমার সাহা, মমতাজ ডাক্তার, মল্লিকপুরের মুনছুর বিশ্বাস ও মথুরাপুর গ্রামের হামিদুল।

বটতলায় কালীপূজার জন্য একটি স্থায়ী পিঁড়ি তৈরি করা হয়েছে। চাপরাইল গ্রামের গৌর পদ অধিকারী এবং হাজারী লাল অধিকারীর আর্থিক সহায়তায় এটি নির্মিত হয়। এলাকাবাসী জানান, অযত্ন-অবহেলা, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব ও নানামুখী অত্যাচারের কারণে ঐতিহ্যবাহী এ বটগাছের অস্তিত্ব আজ নষ্ট হতে চলেছে।

মল্লিকপুর গ্রামের বেলায়েত মিয়া বেঁচে থাকা পর্যন্ত তিনি এসব দেখাশোনা করতেন। তিনি নিজ সন্তানের মতো ভালোবাসতেন এ বটবৃক্ষকে। যে কারণে এ বটগাছের কাছে সর্বপ্রথম দোকান দেন তিনি এবং বাজার প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৯৮ সালের দিকে কালীগঞ্জ উপজেলার ততকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা সুশেন চন্দ্র রায়ের সহযোগিতায় সেখানে একটি ফুলের বাগান তৈরি করা হয়। বটগাছের চারপাশ ঘিরে প্রাচীর নির্মাণের ব্যবস্থাও করেন তিনি।

তবে, বর্তমানে এশিয়ার বৃহত্তম এই বটবৃক্ষের যত্নে অনেক কিছুই করা বাকি রয়েছে বলেই মনে করেন অনেক দর্শনার্থী।