ঢাকা ১২:৫০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীত’ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এখন সময়ের দাবি -মাকসুদুল হক

মামুনুর রশীদ রাজু, ব্যুরো চিফ

‘ফিডব্যাক’ কিংবা ‘মাকসুদ’ নামটা বাদ দিলে বাংলাদেশ ব্যান্ড মিউজিককে অস্বীকার করা হয় বললেও ভুল হবে না।

 

বাংলাদেশ মিউজিক্যাল ব্যান্ডস অ্যাসোসিয়েশন (বামবা)-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিও মাকসুদুল হক। তার কথা, সুর, কণ্ঠ, গবেষণা আর নেতৃত্বে শুধু বাংলাদেশের ব্যান্ড শিল্পই নয়, সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা সংগীত।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রেশ ধরে পটপরিবর্তনের এই নতুন বাংলাদেশের কাছে বিশেষ দাবি নিয়ে হাজির হয়েছেন এই নন্দিতজন। এই সমাজ অথবা রাষ্ট্রের প্রতি তিনি তুলে ধরেছেন বাংলাদেশে ব্যান্ডসংগীতের বিস্তারিত ইতিহাস। যার মধ্য দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন এই ব্যান্ডসংগীত কেমন করে সমৃদ্ধি ও বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশ গঠনের বার্তাবাহক হয়ে জেগে আছে গত পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে। ব্যান্ডের এই ইতিহাস তুলে ধরার পেছনে মাকসুদুল হকের একটাই দাবি, ব্যান্ডসংগীত যেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়। তার ভাষায়, ‘এটা এখন সময়ের দাবি’। তার পুরো বক্তব্যটি হুবহু তুলে ধরা হলো পাঠক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের লক্ষ্যে-

বাংলাদেশে ব্যান্ড সংগীতের যাত্রা শুরু হয়েছিল গত শতাব্দির সাতের দশকে, যখন দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে পরিবর্তনের হাওয়া বইছিল। আজ সেই ব্যান্ড সংগীত শুধু বিনোদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং এটি দেশের নতুন প্রজন্মের প্রেরণা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং সামাজিক সচেতনতা তৈরির ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

ব্যান্ড সংগীতের উত্থান ও শেকড়: ব্যান্ড সংগীতের উত্থান ঘটেছিল এক বিশেষ সময়ে, যখন বাংলাদেশ নবীন রাষ্ট্র হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুনভাবে পথচলা শুরু করেছিল। সে সময়কার তরুণ প্রজন্মের সংগীতপ্রেমীরা নতুন ধরনের সুর, কথা এবং সঙ্গীতায়োজনে নিজেদের চিন্তা-ভাবনাকে প্রকাশ করতে শুরু করেন। তাদের গানগুলোতে ব্যক্তিগত অনুভূতির পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক বিষয়াবলী উঠে আসতে থাকে। প্রেম, বিরহ, দুঃখ-বেদনা – ইত্যাদি ব্যক্তিগত অনুভূতির পাশাপাশি সামাজিক অবিচার, রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদির কথাও তারা সোচ্চারে বলতে থাকেন গানের কথায়, পাশাপাশি আমাদের বাঙালি জাতির ইতিহাস ও বাঙালি সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানও উঠে আসতে থাকে ব্যান্ডের গানে।

মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেমের বার্তা: মুক্তিযুদ্ধ এবং দেশপ্রেমের চেতনা ব্যান্ড সংগীতের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ও পরবর্তী সময়ে রচিত গানগুলোতে দেশের প্রতি ভালোবাসা, সংগ্রাম এবং ত্যাগের কথা তুলে ধরা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আজম খান তাঁর গানগুলোর মাধ্যমে যুদ্ধপরবর্তী সময়ে দেশের যুবকদের মধ্যে নতুন শক্তি এবং উদ্দীপনা সঞ্চার করেছিলেন। তাঁর গানগুলোতে দেশপ্রেমের স্পষ্ট বার্তা ছিল, যা আজও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে অনুপ্রেরণা জোগায়।

নতুন প্রজন্মের প্রেরণা হিসেবে ব্যান্ড সংগীত: বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীত সবসময়ই প্রজন্মের মাঝে বিপ্লবের বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছে। তরুণদের মধ্যে স্বাধীন চিন্তা, নতুন ধারা, এবং সমাজের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে সচেতনতা তৈরিতে বাংলা ব্যান্ড সংগীত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের ব্যান্ডের গানে রাজনৈতিক, সামাজিক, এবং ব্যক্তিগত বিষয়গুলো এমনভাবে উপস্থাপিত হয়েছে যে, তরুণেরা নিজেদের কথা খুঁজে পেয়েছে। তারা এসব গানের সাথে নিজেদের সংযুক্ত করতে পেরেছে। ব্যান্ডের গানের ভাষা, এর কথা ও সুর, এবং শক্তিশালী বার্তা তরুণদের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে এবং তাদেরকে সমাজ পরিবর্তনের জন্য উদ্দীপ্ত করেছে।

অর্থনীতিতে ব্যান্ড সংগীতের অবদান: ব্যান্ড সংগীত শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নেই; এটি দেশের অর্থনীতিতেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। ব্যান্ড কনসার্ট, মিউজিক অ্যালবাম, এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে গানের বিক্রি দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। দেশের বিভিন্ন শহরে নিয়মিত ব্যান্ড কনসার্টগুলো শুধু বিনোদনের জন্য নয়, বরং উপার্জনমূলক কাজের অংশ হিসেবেও ভূমিকা পালন করছে। এসব কনসার্টে প্রচুর দর্শক সমাগম হয় যা সংশ্লিষ্ট শিল্পী, সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার, ইভেন্ট ম্যানেজার, এবং অন্যান্য কর্মীদের আয়ের উৎস হিসেবে কাজ করে। ব্র্যান্ড স্পনসরশিপ এবং মিডিয়া প্রচারণার মাধ্যমে ব্যান্ড সংগীত দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

আসছে বৈদেশিক মুদ্রা: বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীত দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে সারা বিশ্বে। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ ব্যান্ডের গান শুনছেন ইউটিউব, স্পটিফাইসহ বিভিন্ন মাধ্যমে। এইসব মিউজিক প্ল্যাটফর্ম থেকে আসছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। অসংখ্য তরুণের ক্যারিয়ার গড়ে উঠছে। কেবল তাই নয়, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমন্ত্রিত হচ্ছে বাংলাদেশের ব্যান্ডগুলো। সেখানে একের পর এক স্টেটে লাইভ কনসার্ট করে তারা বয়ে আনছে দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক মুদ্রা। সেই সাথে বিশ্ব জুড়ে বসবাসরত বাংলা ভাষাভাষীদের হৃদয়ে পৌঁছে দিচ্ছে এক টুকরো বাংলাদেশ।

সংগীতের আধুনিকায়ন ও উন্নয়নে ভূমিকা: সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বিশ্বব্যাপী আধুনিয়কায়ন হয়েছে সংগীতেরও। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে সংগীতের আধুনিক ধারাগুলো আয়ত্ব করা, সেই সাথে গিটার, কিবোর্ড, ড্রামস ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শেখা ও তাতে দক্ষতা অর্জন ইত্যাদি আমাদের ব্যান্ডগুলোর অবদান। বর্তমান বাংলাদেশে যারাই সংগীত জগতে বিচরণ করছেন, ব্যান্ড সংগীতের বাইরেও রবীন্দ্র-নজরুল-আধুনিক-লোকগীতি ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের গানের সংগীত পরিচালনা করছেন ও নানান বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছেন – এই সকল শিল্পীই কোনো না কোনোভাবে ব্যান্ড সংগীতের কাছে ঋণী, কেননা তাঁদের সংগীত শিক্ষায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অবদান রেখেছেন দেশের কোনো না কোনো ব্যান্ডের সদস্য।

সামাজিক সচেতনতা তৈরিতে ব্যান্ড সংগীত: বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীত সামাজিক সচেতনতা তৈরিতে সবসময়ই অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছে। বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা, যেমন – মাদকাসক্তি নির্মূল, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক দুর্নীতি, কুসংস্কার দূর করা, পরিবেশ সচেনতনা ইত্যাদি নানান বিষয় নিয়ে আমাদের ব্যান্ডগুলো তাদের গানে বার্তা দিয়েছে তরুণ শ্রোতাদের। এই গানগুলো সমাজের অন্ধকার দিকগুলোতে আলোকপাত করেছে এবং মানুষকে সচেতন করেছে। ব্যান্ডের গান কেবল বিনোদনের জন্য নয়, বরং সমাজের বিভিন্ন ইস্যুতে জনসাধারণের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্যও অত্যন্ত কার্যকরী মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে।

প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির: বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীত দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই সংগীত ধারার শিল্পীরা শুধু বিনোদন নয়, বরং দেশের সংস্কৃতি, সমাজ, এবং অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রেখে চলেছেন। অথচ তবুও ব্যান্ড সঙ্গীতকে এখনো রাষ্ট্রীয়ভাবে মর্যাদা দেয়া হয় না। কোনও রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বা স্বীকৃতি এই মাধ্যমের শিল্পীদের জন্য নেই। সমাজে অবদান রাখার জন্য যেখানে অন্যান্যরা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও বিভিন্ন সুবিধাপ্রাপ্ত হচ্ছেন, সেখানে অনেক বেশি অবদান রাখার পরও ব্যান্ড সঙ্গীত শিল্পীরা সেসব থেকে বঞ্চিত। এমনকি, কোনও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে তাদেরকে আমন্ত্রণ পর্যন্ত জানানো হয় না।

এখন সময় এসেছে, ব্যান্ড সঙ্গীত শিল্পীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার। তাদেরকে রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা দেবার। এই অধিকার তাঁরা অর্জন করেছেন। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এই সংগীত ধারার শিল্পীদেরকে ন্যায্য মর্যাদা প্রদান করবে এবং দেশের সংস্কৃতিকে আরও সমৃদ্ধ করবে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকেও এটা অনুপ্রাণিত করবে সংগীতকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে এবং দেশের সংগীতে নিজের মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রয়োগ ঘটিয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে।

ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

আপডেট সময় ০১:৫৬:৪৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৫ অগাস্ট ২০২৪
৬৮ বার পড়া হয়েছে

‘বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীত’ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এখন সময়ের দাবি -মাকসুদুল হক

আপডেট সময় ০১:৫৬:৪৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৫ অগাস্ট ২০২৪

‘ফিডব্যাক’ কিংবা ‘মাকসুদ’ নামটা বাদ দিলে বাংলাদেশ ব্যান্ড মিউজিককে অস্বীকার করা হয় বললেও ভুল হবে না।

 

বাংলাদেশ মিউজিক্যাল ব্যান্ডস অ্যাসোসিয়েশন (বামবা)-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিও মাকসুদুল হক। তার কথা, সুর, কণ্ঠ, গবেষণা আর নেতৃত্বে শুধু বাংলাদেশের ব্যান্ড শিল্পই নয়, সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা সংগীত।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রেশ ধরে পটপরিবর্তনের এই নতুন বাংলাদেশের কাছে বিশেষ দাবি নিয়ে হাজির হয়েছেন এই নন্দিতজন। এই সমাজ অথবা রাষ্ট্রের প্রতি তিনি তুলে ধরেছেন বাংলাদেশে ব্যান্ডসংগীতের বিস্তারিত ইতিহাস। যার মধ্য দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন এই ব্যান্ডসংগীত কেমন করে সমৃদ্ধি ও বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশ গঠনের বার্তাবাহক হয়ে জেগে আছে গত পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে। ব্যান্ডের এই ইতিহাস তুলে ধরার পেছনে মাকসুদুল হকের একটাই দাবি, ব্যান্ডসংগীত যেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়। তার ভাষায়, ‘এটা এখন সময়ের দাবি’। তার পুরো বক্তব্যটি হুবহু তুলে ধরা হলো পাঠক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের লক্ষ্যে-

বাংলাদেশে ব্যান্ড সংগীতের যাত্রা শুরু হয়েছিল গত শতাব্দির সাতের দশকে, যখন দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে পরিবর্তনের হাওয়া বইছিল। আজ সেই ব্যান্ড সংগীত শুধু বিনোদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং এটি দেশের নতুন প্রজন্মের প্রেরণা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং সামাজিক সচেতনতা তৈরির ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

ব্যান্ড সংগীতের উত্থান ও শেকড়: ব্যান্ড সংগীতের উত্থান ঘটেছিল এক বিশেষ সময়ে, যখন বাংলাদেশ নবীন রাষ্ট্র হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুনভাবে পথচলা শুরু করেছিল। সে সময়কার তরুণ প্রজন্মের সংগীতপ্রেমীরা নতুন ধরনের সুর, কথা এবং সঙ্গীতায়োজনে নিজেদের চিন্তা-ভাবনাকে প্রকাশ করতে শুরু করেন। তাদের গানগুলোতে ব্যক্তিগত অনুভূতির পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক বিষয়াবলী উঠে আসতে থাকে। প্রেম, বিরহ, দুঃখ-বেদনা – ইত্যাদি ব্যক্তিগত অনুভূতির পাশাপাশি সামাজিক অবিচার, রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদির কথাও তারা সোচ্চারে বলতে থাকেন গানের কথায়, পাশাপাশি আমাদের বাঙালি জাতির ইতিহাস ও বাঙালি সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানও উঠে আসতে থাকে ব্যান্ডের গানে।

মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেমের বার্তা: মুক্তিযুদ্ধ এবং দেশপ্রেমের চেতনা ব্যান্ড সংগীতের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ও পরবর্তী সময়ে রচিত গানগুলোতে দেশের প্রতি ভালোবাসা, সংগ্রাম এবং ত্যাগের কথা তুলে ধরা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আজম খান তাঁর গানগুলোর মাধ্যমে যুদ্ধপরবর্তী সময়ে দেশের যুবকদের মধ্যে নতুন শক্তি এবং উদ্দীপনা সঞ্চার করেছিলেন। তাঁর গানগুলোতে দেশপ্রেমের স্পষ্ট বার্তা ছিল, যা আজও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে অনুপ্রেরণা জোগায়।

নতুন প্রজন্মের প্রেরণা হিসেবে ব্যান্ড সংগীত: বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীত সবসময়ই প্রজন্মের মাঝে বিপ্লবের বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছে। তরুণদের মধ্যে স্বাধীন চিন্তা, নতুন ধারা, এবং সমাজের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে সচেতনতা তৈরিতে বাংলা ব্যান্ড সংগীত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের ব্যান্ডের গানে রাজনৈতিক, সামাজিক, এবং ব্যক্তিগত বিষয়গুলো এমনভাবে উপস্থাপিত হয়েছে যে, তরুণেরা নিজেদের কথা খুঁজে পেয়েছে। তারা এসব গানের সাথে নিজেদের সংযুক্ত করতে পেরেছে। ব্যান্ডের গানের ভাষা, এর কথা ও সুর, এবং শক্তিশালী বার্তা তরুণদের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে এবং তাদেরকে সমাজ পরিবর্তনের জন্য উদ্দীপ্ত করেছে।

অর্থনীতিতে ব্যান্ড সংগীতের অবদান: ব্যান্ড সংগীত শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নেই; এটি দেশের অর্থনীতিতেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। ব্যান্ড কনসার্ট, মিউজিক অ্যালবাম, এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে গানের বিক্রি দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। দেশের বিভিন্ন শহরে নিয়মিত ব্যান্ড কনসার্টগুলো শুধু বিনোদনের জন্য নয়, বরং উপার্জনমূলক কাজের অংশ হিসেবেও ভূমিকা পালন করছে। এসব কনসার্টে প্রচুর দর্শক সমাগম হয় যা সংশ্লিষ্ট শিল্পী, সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার, ইভেন্ট ম্যানেজার, এবং অন্যান্য কর্মীদের আয়ের উৎস হিসেবে কাজ করে। ব্র্যান্ড স্পনসরশিপ এবং মিডিয়া প্রচারণার মাধ্যমে ব্যান্ড সংগীত দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

আসছে বৈদেশিক মুদ্রা: বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীত দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে সারা বিশ্বে। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ ব্যান্ডের গান শুনছেন ইউটিউব, স্পটিফাইসহ বিভিন্ন মাধ্যমে। এইসব মিউজিক প্ল্যাটফর্ম থেকে আসছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। অসংখ্য তরুণের ক্যারিয়ার গড়ে উঠছে। কেবল তাই নয়, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমন্ত্রিত হচ্ছে বাংলাদেশের ব্যান্ডগুলো। সেখানে একের পর এক স্টেটে লাইভ কনসার্ট করে তারা বয়ে আনছে দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক মুদ্রা। সেই সাথে বিশ্ব জুড়ে বসবাসরত বাংলা ভাষাভাষীদের হৃদয়ে পৌঁছে দিচ্ছে এক টুকরো বাংলাদেশ।

সংগীতের আধুনিকায়ন ও উন্নয়নে ভূমিকা: সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বিশ্বব্যাপী আধুনিয়কায়ন হয়েছে সংগীতেরও। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে সংগীতের আধুনিক ধারাগুলো আয়ত্ব করা, সেই সাথে গিটার, কিবোর্ড, ড্রামস ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শেখা ও তাতে দক্ষতা অর্জন ইত্যাদি আমাদের ব্যান্ডগুলোর অবদান। বর্তমান বাংলাদেশে যারাই সংগীত জগতে বিচরণ করছেন, ব্যান্ড সংগীতের বাইরেও রবীন্দ্র-নজরুল-আধুনিক-লোকগীতি ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের গানের সংগীত পরিচালনা করছেন ও নানান বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছেন – এই সকল শিল্পীই কোনো না কোনোভাবে ব্যান্ড সংগীতের কাছে ঋণী, কেননা তাঁদের সংগীত শিক্ষায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অবদান রেখেছেন দেশের কোনো না কোনো ব্যান্ডের সদস্য।

সামাজিক সচেতনতা তৈরিতে ব্যান্ড সংগীত: বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীত সামাজিক সচেতনতা তৈরিতে সবসময়ই অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছে। বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা, যেমন – মাদকাসক্তি নির্মূল, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক দুর্নীতি, কুসংস্কার দূর করা, পরিবেশ সচেনতনা ইত্যাদি নানান বিষয় নিয়ে আমাদের ব্যান্ডগুলো তাদের গানে বার্তা দিয়েছে তরুণ শ্রোতাদের। এই গানগুলো সমাজের অন্ধকার দিকগুলোতে আলোকপাত করেছে এবং মানুষকে সচেতন করেছে। ব্যান্ডের গান কেবল বিনোদনের জন্য নয়, বরং সমাজের বিভিন্ন ইস্যুতে জনসাধারণের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্যও অত্যন্ত কার্যকরী মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে।

প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির: বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীত দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই সংগীত ধারার শিল্পীরা শুধু বিনোদন নয়, বরং দেশের সংস্কৃতি, সমাজ, এবং অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রেখে চলেছেন। অথচ তবুও ব্যান্ড সঙ্গীতকে এখনো রাষ্ট্রীয়ভাবে মর্যাদা দেয়া হয় না। কোনও রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বা স্বীকৃতি এই মাধ্যমের শিল্পীদের জন্য নেই। সমাজে অবদান রাখার জন্য যেখানে অন্যান্যরা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও বিভিন্ন সুবিধাপ্রাপ্ত হচ্ছেন, সেখানে অনেক বেশি অবদান রাখার পরও ব্যান্ড সঙ্গীত শিল্পীরা সেসব থেকে বঞ্চিত। এমনকি, কোনও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে তাদেরকে আমন্ত্রণ পর্যন্ত জানানো হয় না।

এখন সময় এসেছে, ব্যান্ড সঙ্গীত শিল্পীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার। তাদেরকে রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা দেবার। এই অধিকার তাঁরা অর্জন করেছেন। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এই সংগীত ধারার শিল্পীদেরকে ন্যায্য মর্যাদা প্রদান করবে এবং দেশের সংস্কৃতিকে আরও সমৃদ্ধ করবে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকেও এটা অনুপ্রাণিত করবে সংগীতকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে এবং দেশের সংগীতে নিজের মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রয়োগ ঘটিয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে।